আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। এখন পৌষ মাস, বৃষ্টির মৌসুম না তবুও এরকম ভয়ংকর বৃষ্টি প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে।
এই মুহূর্তে মানিক বিছানায় শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে যেকোনো সময় টিনের চালা উড়ে যাবে, বৃষ্টির পানি ঝমঝমিয়ে তার গায়ে পড়বে। মানিকের তেমন দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে না। যা ইচ্ছা হোক, আজকে দুনিয়া ভেসে যাক।
"ও বুলু, ও বুলু, বৃষ্টি হইতেছে, জানলা দরজা বন্ধ কর। বুলু, ও বুলু......"
ওপাশের ঘর থেকে মানিকের বাবা আসগর আলী ডেকেই যাচ্ছে। এক্ষুনি তার ঘরে না গেলে যেকোনো সময় মানিকের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করবেন, প্রথমে ধীরে, পরে এমনভাবে ধাক্কানো শুরু করবেন, মনে হবে দরজা ভেঙে ফেলবেন। মানিকের বৌ সায়মা খুবই বিরক্ত হবে, মেয়েটা সারাদিন প্রচুর খাটাখাটি করে, পাঁচ মাসের পেট নিয়ে কাজ করতে তার যথেষ্ট কষ্ট হয়। রাতে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালেই খারাপ লাগে। দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে তাদের তিন বছরের ছেলে পাপ্পু উঠে যাবে, মাঝ রাতে বিরাট হৈচৈ শুরু হবে।
মানিক বিছানা ছেড়ে উঠে আসগর আলীর ঘরে গেলো। ঘরের ভেতর ঢুকতেই ভক করে নাকে দুর্গন্ধ লাগলো। গত দুই সপ্তাহ ধরে আসগর আলী প্রায়ই টয়লেটে যেতে ভুলে যান, মল মূত্র ঘরের মধ্যেই ত্যাগ করেন। সায়মা ভারী শরীর নিয়ে সব পরিষ্কার করে। তাদের বাড়িতে কাজের লোক নেই, আসলে মানিকের কাজের লোক রাখার সামর্থ নেই।
আসগর আলী ঘরের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন। পায়জামা পাঞ্জাবি টুপি পরে চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছেন। মানিককে দেখেই বললেন, "আপনি কে? মামা নাকি? বুলু কই?"
মানুক ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো। বুলু হচ্ছেন আসগর আলীর ছোট বোন, বছর পাঁচেক আগেই মারা গেছেন।
"আপনার কী দরকার আব্বা ?" মানিক বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করলো।
"তুফান হইতেছে, দরজা জানালা বন্ধ করন দরকার। বুলু কই?"
"দরজা জানালা বন্ধই আছে। বুলু বাইরে গেছে।"
"এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে গেছে ক্যান? চলেন তো দেইখা আসি কই গেলো?"
মানিক দেখলো, মহা বিপদ আসন্ন। এখন আসগর আলী অবশ্যই লাঠি হাতে বাইরে যাবেন এবং বুলুকে খুঁজতে থাকবেন। না পাওয়া পর্যন্ত খ্যান্ত দেবেন না। এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
"বাইরে বৃষ্টি হইতেছে, বৃষ্টি কমলে যাই। আপনে একটু ঘুমান ।"
"মেয়েটা এই বৃষ্টির মধ্যে কই গেলো? খায় নাই মনে হয়। না, আমি এখন ঘুমাইতাম না, বুলুরে খুঁজতে হইবো। "
মানিকের অসহায় বোধ হচ্ছে। ডাক্তার গত বছরই বলেছে এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, দিন দিন স্মৃতিভ্রষ্ট হতে থাকবেন আসগর আলী, শুধু মনে থাকবে অনেক পুরোনো কথা যেমন তার ছোট বোন বুলুর কথা খুব মনে আছে।
রোগের নাম ডিমেনশিয়া। এই রোগ হলে মানুষ স্মৃতি হারিয়ে ফেলে, যেমনটা হারিয়েছেন আসগর আলী। অতি পুরাতন কিছু স্মৃতি ছাড়া আসগর আলীর আর কোনো সম্বল নেই। মানিকের মনে হয় এই রোগ আসলে বড়লোকদের জন্য উপযুক্ত। তার মতো দরিদ্র ছেলে কেমন করে এমন স্মৃতিভ্রষ্ট বাবার যত্ন করতে পারে? এ রোগ মানিকের জন্য একটা অভিশাপ। আসগর আলী কাউকে চিনতে পারেন না, খাবার খেয়ে ভুলে যান, রাত বিরাতে ঘুম থেকে উঠে বাইরে যাওয়ার জন্য হৈচৈ আরম্ভ করেন, টয়লেটে যেতে ভুলে যান। ডাক্তার খুব সহজ ভাবে বলে দিয়েছে, একটা কেয়ার টেকার যেন আসগর আলীর সাথে সব সময় থাকে। বললেই কি কেয়ার টেকার রাখা যাবে?এমন একটা লোক রাখতে গেলে বেতন দিতে হবে কম করে হলেও সাত-আট হাজার টাকা। মানিক কাজের লোক রাখতে পারে না, সেখানে এমন কেয়ার টেকার রাখা তার পক্ষে কিভাবে সম্ভব? মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে দুবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন আসগর আলী, পাড়ার লোক চিনতে পেরে ধরে বাসায় দিয়ে গেছে। এখন আর তাকে নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে দেয়া হয় না। অথচ আজান শুনলেই আসগর আলী দিশেহারা হয়ে পড়েন, মসজিদে যেতে বাধা দিলে ভয়ংকর রেগে যান আর সামনে যাকেই পান ধাক্কা ধাক্কি শুরু করেন।
সায়মা এক হাতে সব করে, মুখে কিছু না বললেও চোখে মুখে বিরক্তি ঝুলে থাকে, ঠিক মতো কথা বলে না। দিন শেষে একটু আদর করে কাছে ডাকতে গেলে ক্যাটক্যাট করে উঠে, খটখটে শুকনো গলায় বলে, "ঘুমাইতে দাও তো, এইসব ভালো লাগে না। "
মানিক বোঝে, সারাদিন কি যায় সায়মার উপর। পাপ্পু একটা বিচ্ছু বাচ্চা, দুনিয়ার সব ধরণের দুষ্টুমি করতে সে সিদ্ধহস্ত। এদিকে সায়মার পেটে আরেকজন। সাথে আসগর আলীর দেখাশোনা।
অনেকক্ষন ধরে একথা সেকথা বলে ভুলিয়ে আসগর আলীকে খাটে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। গভীর রাতে মানিক ঘুমাতে আসে। সায়মা দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে আছে, মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে পাপ্পু ঘুমাচ্ছে। ছেলেটা পরশুদিন খেলনার দোকানে একটা গাড়ি কেনার আবদার করেছিলো। মানিক কিনে দেয়নি বলে দোকানের মেঝেতে শুয়ে সে কি কান্না! সায়মা পাপ্পুর গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে টেনে হিঁচড়ে দোকান থেকে বের করে আনলো। মানিকের খুব কষ্ট লেগেছে। ছেলেটার ছোটোখাটো শখ পূরণ করতে পারছে না, সামনে আরেকজন আসছে।
স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে বাইরে ঘোরার সুযোগ মানিক খুব একটা পায় না। সে একটা ছোট খাটো ঔষধ কোম্পানীর মার্কেটিংয়ের কাজ করে, জায়গায় জায়গায় গিয়ে ওষুধের গুণগান করে বিক্রি করা। বেতনের সাথে কমিশন পাওয়া যায়। গত তিন মাসে তার পারফরম্যান্স খুব খারাপ। বড় কোম্পানি গুলো নানা রকম ডিজিটাল ক্যাম্পাইন করছে, ইভেন্ট করছে, তাদের বিক্রি ভালো। মানিক যেখানে কাজ করে তারা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছে। গত মাসে মানিকের চাকরি চলে গেছে। সে তিন দিন আগে ছুটির দিনে পাশের বাড়ির খালার বাসায় আসগর আলীকে দুই ঘন্টার জন্য রেখে সায়মা আর পাপ্পুকে নিয়ে পার্কে গিয়েছিলো, উদ্দেশ্য সায়মাকে চাকরি হারানোর খবরটা ধীরে সুস্থে জানানো। সায়মা বললো ঘরের কিছু জিনিস কিনবে। মানিক তাকে নিয়ে মার্কেটে গেলো। সায়মা একটা দোকানে ঝুলানো বাচ্চাদের কাপড় দেখতে ঢুকতেই যত বিপত্তি। সেখানে খেলনা গাড়ি দেখে পাপ্পু এমন যন্ত্রনা শুরু করলো। এরপর সায়মাকে আর কিছু বলা হলো না।
মানিক সাবধানে মশারি উঠিয়ে পাপ্পুর পাশে শুয়ে পড়লো। তার ঘুম আসছে না। চোখের সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই। হটাৎ করে চারদিক ঝলসে বিদ্যুৎ চমকালো। পাপ্পু কেঁপে উঠেছে।
"তুমি ঘুমায় গেছো? একটু কথা ছিলো।" সায়মা শান্ত কণ্ঠে বললো। মানিক সামান্য চমকে তাকালো। সায়মা ঘুমায়নি, ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিলো।
"তুমি ঘুমাও নাই ?"
"না। আব্বা আজকে আবার পাপ্পুরে থাপ্পড় মারছে। "
মানিক কিছুক্ষনের জন্য স্তব্ধ হলো। "আব্বার মাথার তো ঠিক নাই, তুমি একটু মানায় নেও। "
সায়মা উঠে বসলো। তারপর কটমট করে বললো, "আর কত মানায় চলতাম? আমারে থাপ্পড় মারে মানলাম , কিন্তু আমার পোলারে কেন মারবে? এইটুক বাচ্চা কী বুঝে?"
"সায়মা, আমার বাপও এখন পাপ্পুর মতোই বাচ্চা, ডাক্তার বলছে, শুনো নাই ? পাপ্পু দোষ করলে তুমি মারো না? আব্বা মারছে দেইখা রাইতের বেলায় ঝগড়া করতে শুরু করলা?"
"আমি কোনো ঝগড়া করতেছি না। দিনের পর দিন তোমার আব্বার গু মুত সাফ করতে করতে আমি ক্লান্ত। নিজের জীবন বইলা আমার কিছু নাই, যখন তখন আমার ঘরে ঢুইকা পরে, আমারে যা তা বলে, মারতে আসে। এমন পাগল লোক নিয়ে আমি আর কতদিন চলমু? শুনো, আমার নিজের শরীরও খারাপ। ডাক্তার বলছে রেস্ট করতে। তোমার এই পাগলখানায় তো আমার কোনো রেস্ট নাই, আমি কয়দিন বাপের বাড়ি দেইখা ঘুইরা আসি। তোমার পাগল বাপরে তুমি কয়দিন দেখো।" চাপা কর্কশ স্বরে কথাগুলো বললো সায়মা।
"সায়মা আমার তো চাকরি আছে, তুমি চইলা গেলে আমি কেমনে অফিসে যাবো? ঘর কে সামলাইবো? পাগলের মতো কথা বলতেছো কেন?"
"তোমার এই পাগলখানায় থাকতে থাকতে আমিও পাগল হইয়া গেছি, তাই পাগলের মতো কথা বলি। তোমার যে চাকরি চইলা গেছে, সেইটা আমি জানি। তুমি সারাদিন এদিক ওদিক ঘুইরা কাটাও, অফিস তো করো না। আমার কপালে আরো কত দুর্দশা যে আছে। " শেষের কথা গুলো কান্নার সাথে মিলে কেমন ভুতুড়ে শোনায়। সায়মা কাঁদতে কাঁদতে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
মানিকের চোখ জ্বালা করছে। আসগর আলীর ঘর থেকে আবার খুটখাট শব্দ আসছে, সম্ভবত তিনি ঘুম থেকে উঠে ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করছেন। এমনটা প্রায়ই করেন। সায়মার ঘুম পাতলা, শব্দে সে ঘুমাতে পারে না , বেশিভাগ রাত নির্ঘুম কাটায় মেয়েটা। তার চোখের কোলে গাঢ় কালি। সায়মা আজকেও ঘুমের ভান করেই পড়ে আছে। মানিকের অবশ্য ঘুমের সমস্যা নেই, যেকোনো জায়গায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। তবে আজকে ওর ঘুম আসছে না। আজকের রাতটা যেন অসীম।
ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল মানিক। বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙলো। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো বারান্দায় চেয়ারে আসগর আলী বসে আছেন। মানিককে দেখে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, "এত দেরি কইরা উঠলি মনি? ক্লাস নাই আজকে?"
তার মানে মানিককে এই মুহূর্তে চিনতে পারছেন আসগর আলী। একটু পরেই হয়তো আবার ভুলে যাবেন।
"আব্বা, কিছু খাইবেন না? "
"খামু তো? ওই মাইয়াটা কই? আমারে আজকে খাবার দিলো না ক্যান?"
মানিক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সায়মা সম্ভবত ভোরেই পাপ্পুকে নিয়ে ওর বাপের বাড়ি কুলিয়াচরে চলে গেছে, এখন থেকে বাসে যেতে দুই ঘন্টা লাগে। মানিকের কেমন অভিমান হচ্ছে, এই শরীরে একা একা না গেলেই কি হতো না?
পাউরুটি আর ডিম সিদ্ধ খেলো মানিক আর আসগর আলী। কয়েকবার সায়মা আর পাপ্পুর কথা জিজ্ঞেস করলেন আসগর। মানিক কিছুই বললো না। দুপুরে কি খাওয়া হবে সেই চিন্তা মাথায় ঘুরতে লাগলো। ঘরে একটা ছোট ফ্রিজ আছে, সেখানে একটা বাটিতে কেঁচকি মাছের তরকারি আছে, আরেক বাটিতে একটু ডাল, ওই দিয়ে দুপুর পার করা যাবে কিন্তু রাতে কি হবে? আজকে দুপুরে একটা চাকরির ইন্টারভিউ হওয়ার কথা, সেখানেই বা যাবে কেমন করে? আসগর আলীকে একা বাড়িতে রেখে যাওয়া সম্ভব না। পাশের বাড়ির খালা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন তিনি আর কখনোই আসগর আলীকে তার বাড়িতে রাখবেন না। সেদিন নাকি আসগর আলী তার খাটের উপর মূত্র ত্যাগ করেছেন।
"আব্বা, বারোটার দিকে আমার সাথে এক জায়গায় যাইবেন। আমার চাকরির ইন্টারভিউ আছে, আপনে ওইখানে কিছুক্ষন বসবেন, আমি ইন্টারভিউ দিবো।"
আসগর আলী না বুঝেই মাথা নাড়লেন। অনেক কথা শুনলেও তিনি অর্থ মেলাতে পারেন না। কুৎসিত রোগটা পোকার মতো তার মগজের সিন্দুক থেকে সব বোধ শক্তি খেয়ে ফেলছে।
মানিক নিজের ঘরে গিয়ে তৈরী হলো। সায়মা পরিপাটি মেয়ে, আলনায় সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট ইস্তিরি করে ঝুলিয়ে রেখেছে। এবার আসগর আলীকে কাপড় পরিয়ে দিলো সে, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি আর টুপি, হাতে লাঠি। লাঠি নিতে আসগর আলীর প্রবল আপত্তি ,তার মতে তিনি এখনো এত বুড়ো হন নি যে লাঠি হাতে চলাফেরা করতে হবে।
রিকশায় উঠে আসগর আলী দিশেহারা দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে লাগলেন , তিনি কিছুই চিনতে পারছেন না। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, "আমরা কই যাই মামা?"
মানিক উত্তর দিলো না। তার বাবা তাকে মামা ডাকে, ব্যাপারটা এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। নানা দুশ্চিন্তায় তার মাথা ভার হয়ে আছে। চাকরি জোগাড় করা খুব জরুরি। না হলে কি হবে সেটা ভাবতে পারছে না সে। দুই মাসের বাকি বাড়ী ভাড়া, বাবার চিকিৎসা, তাদের অনাগত সন্তান, দৈনন্দিন খরচ - সব হিসাব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতর।
অফিসের নিচে রাস্তায় ছোট একটা চায়ের দোকানে আসগর আলীকে বসিয়ে দোকানদারের হাতে বিশ টাকার একটা নোট দিলো মানিক, বললো তার বাবার দিকে একটু নজর রাখতে। আসগর আলীকে বারবার বললো প্রয়োজন হলে যেন অফিসের নিচের তলায় বাইরের দিকের টয়লেটে যায়। আসগর আলী মাথা নাড়লেন, কি বুঝলেন মানিক নিশ্চিত হতে পারলো না।
দোতালায় অফিসের ছোট রিসিপশনে মানিকের আগেই আরো চারজন এসে বসে আছে ইন্টারভিউয়ের জন্য। অবশ্য কাউকেই শক্ত প্রতিপক্ষ মনে হচ্ছে না মানিকের। চাকরির অভিজ্ঞতা ও কাজের দক্ষতা বেশ মজবুত। তারপরও কেমন যেন ভয় লাগছে। নিচে তার বাবা কি করছেন সেটাও চিন্তার বিষয়। মানিকের একবার মনে হলো এখানেই বাবাকে এনে বসালে কেমন হয়? কিন্তু পূর্ণবয়স্ক ছেলের সাথে বুড়ো বাবা চাকরির ইন্টারভিউতে এসেছে -বিষয়টা হাস্যকর হবে না? তাছাড়া ওর বাবা অসংলগ্ন কথা বলে অযথাই লোক হাসবেন। তারচেয়ে ঝটপট ইন্টারভিউ শেষ করে চলে গেলেই ল্যাঠা চুকে যায়। মানিক বারবার হাতঘড়ি দেখতে লাগলো। রিসেপশনে শুকনো মুখে বসে থাকা রিসেপসনিস্ট লোকটাকে দুবার বললো তার ইন্টারভিউটা আগে আগে নেয়ার জন্য। লোকটা ক্লান্ত চোখে তাকালো শুধু, কিছুই বললো না।
বেশ অনেকক্ষন পরে মানিকের পালা এলো। করিডোর ধরে একটা বড় ঘরে লম্বা টেবিলের এক পাশে তিনজন বসেছেন। মাঝখানের জন মানিককে ইশারায় বেশ অবজ্ঞার সাথেই বসতে বললেন। নাম পরিচয় চাকরির ইতিহাস জানা শেষ হতেই রিসেপশনের শুকনো মুখের ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে দরজা ঠেলে ঢুকে বললো, "আপনি কি মানিক? নিচে আপনার বাবাকে রাইখা আসছিলেন? উনি তো নিচে মারামারি লাগায় ফেলছে। তাড়াতাড়ি আসেন।"
তিনজন বড় কর্তাকে হতভম্ব করে মানিক এক ঝটকায় ইন্টারভিউ রুম থেকে ছুঁটে বেরিয়ে নিচে এলো। তার বাবা দোকানদারের সাথে হাতাহাতি করছে! পঁচাত্তর বছর বয়সের শরীরে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে, হাতের লাঠি উঁচিয়ে মারতে আসছেন। দোকানদারও কম যায় না, হাতের সাথে তার মুখেও অবিরাম গালাগালি বেরিয়ে আসছে। চারপাশে বেশ লোকজন জড়ো হয়েছে। দোকানদারের চিৎকারের মাঝে "পাগল বুইড়া" কথাটা শুনেই মানিক বুঝে ফেললো কি হয়েছে। তার বাবা "পাগল" শব্দটা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।
মানিক ভিড় ঠেলে আসগর আলীকে টেনে বের করে আনলো। আসগর আলী তখন লাঠি উঁচিয়ে অদৃশ্য কোনো শত্রুকে মেরে চলছেন। পেছনে ক্ষীণ হয়ে আসে দোকানদারের হুংকার ,"পাগল বুইড়ারে দোকানে রাইখা গেছে, বিশ ট্যাকা কেন, বিশ হাজার ট্যাকা দিলেও এই পাগল ছাগল আমার দোকানে বইতে পারবো না.........."
মানিকের মাথার ভেতরটা রাগে দপদপ করছে। পৃথিবীতে তার মতো দুর্ভাগা আর কেউ নেই। এমন একটা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে প্রতিনিয়ত বহন করার যন্ত্রনা আর কেউ বুঝবে না।
মানিক তার বাবাকে নিয়ে রিক্সায় উঠলো। রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবে, মানিক কিছুই বললো না। আসগর আলী শান্ত হয়ে বসে আছেন। মানিক বাস স্টেশনে এসে গাছিয়াহাট যাওয়ার দুইটা টিকেট কিনলো। বাসে উঠতে আসগর আলী একটু আপত্তি করলেন, দুইবার বললেন বাসায় যাবেন। মানিক তাকে টেনে বাসে ওঠালো।
বাসে পুরো সময় রাগে মানিকের চোয়াল শক্ত হয়ে থাকলো, কপাল কুঁচকে রইলো। আজকে আসগর আলীর একটা বিহিত করবে মানিক।
বিকেলের দিকে গাছিয়াহাট পৌছালো ওরা। আসগর আলী কয়েকবার বললেন তার খিদে পেয়েছে, মানিক পাত্তা দিলো না, তার নিজেরও খিদে পেয়েছে। সে তার বাবাকে নিয়ে গাছিয়াহাট ট্রেন স্টেশনে বসালো, বাবার পকেটে দুশো টাকা রেখে একটা বেঞ্চে বসতে বললো। খাবার আনার কথা বলে আসগর আলীকে স্টেশনে ফেলে আসার সময় আসগর আলী মানিকের হাতটা কিছুক্ষন শক্ত করে ধরে থাকলেন। ঘোলাটে চোখে মানিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, "কোথায় যান মামা? বাসায় যামু না?"
মানিকের বুকের ভেতরটা একটু দুলে উঠলো। কয়েক মুহূর্তে সেই কম্পন থেমেও গেলো। এই অসুস্থ লোকটা না থাকলে তার জীবন অনেক সহজ হবে। তার মানসিক অথবা আর্থিক অবস্থা এমন নয় যে আসগর আলীর দেখাশোনা করতে পারবে। তার বড় বোন রত্নার অবস্থা আরো খারাপ, বাবার বোঝা সেও নিতে অপারগ। এই অবস্থায় আর কী করার আছে মানিকের?
অপরাধবোধকে চাপা দিতে মনে মনে বাবাকে বিসর্জন দেয়ার হাজার অকাট্য যুক্তি ভাবতে লাগলো সে। পেছন ফিরে আসগর আলীর দিকে তাকালো না, যদি মায়া পড়ে যায়? আসগর আলির পাঞ্জাবির পকেটে কিশোরগঞ্জের একটা দাতব্য বিদ্ধাশ্রমের ঠিকানা দিয়ে রেখেছে মানিক, বিদেশিরা নাকি চালায় সেটা । স্টেশনে বেশ লোক ,কেউ তার বাবাকে সাহায্য করতে চাইলে ঠিকানা পাবে আর ঠিকঠাক ওখানে পৌঁছে দেবে। আর মানিক সবাইকে বলবে স্টেশন থেকে তার বাবা হারিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ যদি জানতে চায় এই স্টেশনে কেন এসেছে মানিক? বলতে তো পারবে না যে বাড়ি থেকে দূরে ইচ্ছা করেই এই স্টেশনে এসেছে সে, যেনো আসগর আলী কিছুতেই বাড়ি ফেরার রাস্তা খুঁজে না পায়। আর এই স্টেশনে কেন এসেছে সেটার একটা যুক্তিযুক্ত কারণ চিন্তা করে নিশ্চই বের করা যাবে।
গভীর রাতে ফাঁকা বাড়িতে ফিরলো মানিক। সায়মার মোবাইলে সারাদিন ফোন করে পায়নি, এখনো ফোন বন্ধ। এত রাগ মেয়েটার! মানিকের খুব ইচ্ছা করছে ফোন করে বলতে, "বাসায় ফেরত আসো সায়মা, আপদ বিদায় হইছে।"
মানিক ধীর পায়ে আসগর আলীর ঘরে যায়। কটু গন্ধটা নাকে লাগে তবু মানিক কিছুক্ষন চুপ চাপ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ কেমন জ্বালা করে তার। এত রাতে বাবা কোথায় আছেন? কিছু কি খেয়েছেন ? কোথায় ঘুমাবেন? ধুর, কিসব অর্থহীন চিন্তা। মানিকের উচিত এখন চাকরির চিন্তা করা, সায়মা আর পাপ্পুকে ফেরত নিয়ে আসার চিন্তা করা, অনাগত শিশুর জন্য প্রস্তুতি নেয়া।
মানিক বারান্দায় এসে কাঠের চেয়ারটায় বসলো। এই চেয়ারে তার বাবা প্রায়শই বসতেন। এখন চেয়ারটা তার। মানিকের হটাৎ মনে হলো আসগর আলীর ঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। মানিক চমকে উঠে সেই ঘরে আবার ঢুকলো, কিছুই নেই। ইঁদুর হতে পারে। ঘরটা স্যাঁতস্যাঁতে, এই পুরোনো বাড়ির ঘর গুলো কেমন ভ্যাপসা। এর চেয়ে ভালো থাকার জায়গার আয়োজন করা মানিকের পক্ষে সম্ভব না। ওর ঘরটা তাও কিছুটা খোলামেলা, দুইদিকে দুইটা জানালা। এই ঘরে কোনো জানালা নেই। এমন একটা ঘরে তার বাবা দিন রাত কি করে থাকতেন! অদ্ভুত ব্যাপার, এই ব্যাপারটা মানিক কখনো খেয়াল করেনি। সে কাজ শেষে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতো, এত কিছু খেয়াল করার সময় কোথায়।
মানিক নিজের ঘরে এসে কাপড় পাল্টে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঘর ভর্তি মশা কিন্তু ওর মশারি টাঙাতে ইচ্ছা করছে না। বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাবা এখন কোথায় আছেন- এই চিন্তাতে জোর করে সরিয়ে রাখলো মানিক। কয়েকদিন খারাপ লাগবে তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। কালকে একবার থানায় গিয়ে বাবার হারানোর ব্যাপারে একটা জানান দিয়ে আসবে নাকি? নাহলে আবার যদি আইনি সমস্যায় পড়তে হয়? আসে পাশের সবাইকে বলতে হবে তার বাবা হারিয়ে গেছে, সবাই কৃতিম দুঃখে চুকচুক করবে, মানিকের বাবা হারিয়ে গেলে কার কী এসে যায়?
বাবা সারাদিন কিছুই খায়নি-এই চিন্তার একটা কাঁটা মানিককে অকারণ অস্বস্তি দিতে থাকলো। তবুও ক্লান্তির কাছে দুশ্চিন্তা হার মানলো। মানিক একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। হটাৎ ঘুম ভাঙলো ওর। বারান্দার বাতি জ্বলছে। কে যেন নিচু স্বরে কাশছে। মানিক ধড়ফড় করে উঠে বারান্দায় এলো, তার বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করছে। বারান্দার চেয়ারে তারা বাবা বসে আছেন!
বাইরে প্রবল বৃষ্টি, আসগল আলীর পাঞ্জাবি পায়জামা ভিজে চপচপ করছে, ঠান্ডায় তিনি অল্প অল্প কাঁপছেন। মানিককে দেখে আসগর আলী স্পষ্ট ভাবে বললেন, "দেখলি মানিক, হোসেনপুর সরকারি স্কুলের অংকের শিক্ষককে পাগল বললো? কত ছাত্রছাত্রীকে অংক শিখাইলাম, এমপি সাহেব সেরা শিক্ষকের পুরস্কার দিলো আর আমারে পাগল বললো ! তুমি লোকটারে কিছুই বললি না উল্টা আমারে স্টেশনে ফালায় আসলি?"
মানিক হতভম্ব! বাবাকে দেখে মনেই হচ্ছে না ডিমেনশিয়া নামক অভিশপ্ত রোগটার কোনো নাম গন্ধ তার মধ্যে আছে! আর কিভাবেই বা বাসায় ফিরলেন? কে দরজা খুললো? সে কি ভুল করে দরজা আটকায়নি?
মানিক অপ্রস্তুত হয়ে বললো, "ফালায় আসি নাই আব্বা, আপনে হারায় গেছেন।"
আসগর আলী মুখে রহস্যময় হাসি টেনে বললেন, "তোর মনে আছে, তুই অংকে কত কাঁচা ছিলি ? তোরে নিয়া সন্ধ্যায় পড়তে বসতাম আর তুই ঘুমে ঢুলতি। তখন আমি একটা খেলা শুরু করলাম। তুই আর রত্না পরীক্ষা অংকের দিতি , যে বেশি নাম্বার পাইতো তারে বাজারে হরির মিষ্টির দোকান থেইকা ছানার সন্দেশ কিন্না দিতাম। সন্দেশের লোভে তুই আস্তে আস্তে অংক শিখতে শুরু করলি।"
মানিক মাথা নিচু করে রাখলো। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
"খিদা আমার একদম সহ্য হয়না রে বাপ। একদিন স্কুল থেইকা আইসা দেখি বাড়িতে তোর মা কিছুই রান্দে নাই। তার শরীল ভালো ছিল না। তুই আমারে ডিম ভাজি কইরা খাওয়ালি। এত মজার ডিম ভাজি আমারে আর কেউ কোনোদিন খাওয়ায় নাই। তখন কত ছিল তোর বয়স? দশ? নাকি এগারো?"
আসগর আলী কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন। তারপর নিচু স্বরে বললেন, "আমারে হারায় ফেললি মনি? আমারে আর খুইজা পাবি না কোনোদিন। "
মানিক চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো তার বাবা নেই। সে চিৎকার করে বাবাকে ডাকলো। তখন তার হুশ হলো, সে স্বপ্ন দেখছিলো। ভোর চারটা বাজে। মানিকের চোখ ভেজা, স্বপ্ন দেখতে দেখতে কাঁদছিলো সে। সে স্পষ্ট দেখলো স্টেশনে তার চলে যাওয়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার বাবা।
এত ভোরে গাছিয়াহাট যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে না। গৌরহাটি সদর পর্যন্ত যেয়ে অন্য কোনো ভাবে যাওয়া যাবে। মানিক সদরে যাওয়ার বাসে উঠলো। গৌরহাটি পৌঁছে আরেকটা বাস নিয়ে গাছিয়াহাট। স্টেশনে পৌঁছে হুড়মুড় করে প্লাটফর্মে ঢুকলো। মন বলছে তার বাবা এখনও সেই বেঞ্চে বসে তার অপেক্ষা করছেন।
কিন্তু আসগর আলী সেখানে নেই। মানিকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো। হকার, টোকাই, স্টেশন মাস্টার সবাইকে জিজ্ঞেস করলো, কেউ কিছু জানে না। মানিক বারবার চোখ মুছছে। এখন সবাই বিশ্বাস করবে তার বাবা আসলেই হারিয়ে গেছে আর মানিক তাকে খোঁজার সব চেষ্টাই করেছে। ছোকরা মতো চা ওয়ালা বললো একটা বুড়ো লোক নাকি গত রাতে তার কাছ থেকে চা খেয়ে দুইশ টাকা বখশিস দিয়েছে, সাথে ধরিয়ে দিয়েছে এক টুকরো কাগজ। ছেলেটা পকেট থেকে কাগজের টুকরোটা বের করে দেখালো, মানিকের নিজের হাতে লেখা সেই বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা।